ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের পিতাকে গগনচুম্বী করে তুলবার যে সকল কৌশলের উদ্ভাবনা ও প্রয়োগে অবিশ্রাম লিপ্ত ছিলেন, সেগুলোর মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই পরলোকগত পিতার দ্বিতীয় মৃত্যুটি ঘটালেন। লোকে বলাবলি করছে, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একটি অংশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে; ৪৯ বছর পরে তাঁর নিজের কন্যা তাঁকে দ্বিতীয়বার হত্যা করলেন। সেবার নিহত হয়েছিলেন নেতা বঙ্গবন্ধু, এবার নিহত হলেন ব্যক্তি শেখ মুজিব।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের কাজটা শুধু যে মৌলবাদীরা ঘটিয়েছে, তা নয়। সাধারণ মানুষও হাত লাগিয়েছে; কারণ তাদের ক্ষোভ ও ক্রোধ পুঞ্জীভূত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকন্যার ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এখন অসংখ্য মামলা দেওয়া হচ্ছে। উৎসবের মতো ঘটনা, যে উৎসব আগে চলছিল আওয়ামী লীগের শাসনকালে। তবে তাঁর বিরুদ্ধে পিতৃহত্যার মামলাটা কেউ করবেন না; যদিও সবচেয়ে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ছিল ওটিই; এবং ঘটেছিল তাঁর ব্যক্তিগত তৎপরতায়।
পত্রপত্রিকায় পিতা বা মাতাকে হত্যা করার খবর পাওয়া যায়, নেপথ্যে থাকে সম্পত্তিপ্রাপ্তির লোভ। বঙ্গবন্ধুকন্যা যে নিজের হাতে পিতৃ-হত্যাকাণ্ড ঘটালেন, সেটা অবশ্য একটু ভিন্ন কারণে। সম্পত্তি তো তিনি পেয়েছিলেনই, সেই সম্পত্তি বাড়াবেন ও ব্যক্তিমালিকানা চিরস্থায়ী করবেন– এই ছিল অভিলাষ। ক্ষমতা সম্পত্তিই বটে, অস্থাবর যদিও, তবুও অতিশয় মূল্যবান বৈ কি। তাকে রক্ষা করার জন্য সৈন্যসামন্ত লাগে। সে বন্দোবস্তও করা হয়েছিল। শেষ রক্ষা হয়নি, এই যা। মাঝখান থেকে যা ঘটালেন, সেটা শুধু নিজের পতন নয়, পিতার যা কিছু অর্জন ছিল সেগুলোও ধসিয়ে দেওয়া। কন্যার ভালোবাসার এই নিষ্ঠুরতাকে পঁচাত্তরের ঘাতকদের বর্বর নৃশংসতার তুলনায় বোধ করি কম বলা যাবে না। ইতিহাসের বঙ্গবন্ধু তাঁর মর্যাদার নির্ধারিত স্থানটি অবশ্যই ফেরত পাবেন; কিন্তু সে জন্য প্রয়োজন হবে কন্যাসৃষ্ট প্রতিবন্ধক সরিয়ে ফেলার।
পিতা চলে গেলেই পিতৃতান্ত্রিকতা যে বিদায় হয়, তা নয়। পিতৃতান্ত্রিকতার অবসান ঘটানোর জন্য সামাজিক বিপ্লব আবশ্যক। আমাদের দেশে সে বিপ্লব আজও ঘটেনি। মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকারের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি; ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণও যে সহসা ঘটবে, এমন আশা নেই। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর নিশ্চয়তা-প্রাপ্তি দূরের সুখস্বপ্ন বটে। আর সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যেহেতু ব্যক্তিমালিকানার জায়গাতে সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা ঘটেনি, তাই বৈষম্য উৎপাদনের প্রকৃত ক্ষেত্রটি অক্ষুণ্নই রয়ে গেছে।
আর স্বাধীনতা? সেটা তো আমরা বারবার পাচ্ছি। সাতচল্লিশে পেলাম, পেলাম একাত্তরে; বলা হচ্ছে, এবারও পেয়েছি। কিন্তু প্রকৃত স্বাধীনতা পেয়েছি কি? আবারও স্মরণ করা যাক, প্রকৃত স্বাধীনতার নাম হচ্ছে মুক্তি। মূলত অর্থনৈতিক মুক্তি। সেই মুক্তি আশপাশে কোথাও নেই। বৈষম্যের রাজত্বই সর্বত্র ব্যাপ্ত। ওই বৈষম্যের রক্ষক হচ্ছে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ। ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদেরই নিকৃষ্টতম রূপ।
বুর্জোয়ারা ভূমি, নদী, বন, ব্যাংক যা কিছু দেখতে পেয়েছে সবকিছু লুণ্ঠন করে কিছুটা ব্যক্তিগত ভোগে, বাকিটা বিদেশে পাচারের কাজে লাগিয়েছে। পুঁজিবাদী ধারায় তারা যে উন্নয়ন ঘটিয়েছে তাতে মেহনতি মানুষ, যাদের শ্রমে উন্নয়ন ঘটেছে তারা কেবল বঞ্চিতই নয়, উন্নয়নের চাপে বিধ্বস্তও বটে। বাংলাদেশে বর্তমান যে সংকট, সেটি বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং তার শাসকগোষ্ঠী দ্বারা সৃষ্ট। রাষ্ট্রের এই শাসকেরা দেশপ্রেমবিবর্জিত এবং আত্মস্বার্থপুষ্টির সাধনায় লিপ্ত। সম্রাটদের গায়ে জামাকাপড় নেই। ভুক্তভোগী জনগণ সবই দেখে; কিন্তু কিছু বলতে পারে না; কারণ তাদের নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠেনি।
এবারকার গণঅভ্যুত্থান আগের অভ্যুত্থানগুলোর থেকে বেশ কিছুটা ভিন্ন। অভ্যুত্থান ছাত্ররা শুরু করলেও এর যে শক্তি ও বেগ, সেটা সৃষ্টি হয়েছে বিপুলসংখ্যক জনমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। ঊনসত্তরেও ছাত্ররা আরম্ভ করেছিল; অংশ নিয়েছিলেন কর্মজীবী ও মেহনতিরা। কিন্তু অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তখন এমন ব্যাপকতা ও এতটা স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা যায়নি। এত রক্তও ঝরেনি। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে এগোচ্ছিল; কিন্তু থামিয়ে দিয়েছে বুর্জোয়ারা; তাদেরকে সামাজিক বিপ্লবের আতঙ্কে পেয়েছিল। এবারের অভ্যুত্থানের জমিনটাও হঠাৎ করে তৈরি হয়নি; একদিকে ছিল মানুষের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ এবং সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক কাজ; অন্যদিকে দু’য়ের বিপরীতে ফ্যাসিবাদী সরকারের অভাবনীয় সন্ত্রাস। জমিন তৈরি হচ্ছিল দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, কিন্তু তাঁর শাসন ছিল পুরোদস্তুর পিতৃতান্ত্রিক। তিনি দমনপীড়নের যে নজির রেখে গেলেন, সে-কাজ স্বাধীন বাংলাদেশের অন্য কোনো শাসক করতে পারেননি। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দশ বছরের বেশি তাঁর শাসন কায়েম রাখতে পারেননি। জনতার অভ্যুত্থানে ভূপতিত হয়েছেন। এরশাদও চেয়েছিলেন সশস্ত্র বাহিনীকে ব্যবহার করে, রক্তপাত ঘটিয়ে টিকে যেতে। সশস্ত্র বাহিনী সম্মত হয়নি বলেই তাঁকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল। তবে তিনি পালাতে পারেননি; সদ্যপতিত প্রধানমন্ত্রী যেমনটা পেরেছেন। অবশ্য বলতে হবে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। শেষ মুহূর্তেও তাঁর ইচ্ছা ছিল সশস্ত্র বাহিনী আরও বল প্রয়োগ করুক। কিন্তু বাহিনীর প্রধানরা সম্মত হননি। যে দেশবাসীকে রক্ষার জন্য তারা প্রতিপালিত, তাদের রক্তেই মাতৃভূমিকে সয়লাব করে দেবেন, এমন কাজে সায় দেওয়াটা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ এবারকার অভ্যুত্থানের ব্যাপকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা দুটোই ছিল অনেক বিস্তৃত ও গভীর।
বৈষম্য-বিরোধিতার যে আওয়াজ উঠেছিল, সেটা ছিল প্রায় সর্বজনীন। শিক্ষার্থীরা চাকরিক্ষেত্রে সুযোগের বৈষম্য মানবে না বলে ফুঁসে উঠেছিল, কিন্তু তাদের অভিভাবকদেরও অধিকাংশের বুকের ভেতর ছিল ওই একই আওয়াজ। কারণ তারাও নানাভাবে এবং বহু রকমের বৈষম্যের দ্বারা ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। সমাবেশ ও মিছিলে যারা এসেছেন, তারা বৈষম্য কী জিনিস সেটা মর্মে মর্মে জানেন। কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের ‘সুদৃশ্য’ অট্টালিকাটি যে দাঁড়িয়ে আছে তার গোড়ায় রয়েছে বৈষম্য। যাদের শ্রমে এর নির্মাণ, তারা এই অট্টালিকার আরামদায়ক অভ্যন্তরে ঠাঁই পান না; তারা থাকেন নির্মাণের ফলে তৈরি খানাখন্দে। অসন্তুষ্ট ও অশ্রুসিক্ত বঞ্চিতদের কাঁধের ওপর ভর করেই গোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা টিকে আছে; নিচের মানুষ নড়েচড়ে উঠলেই সর্বনাশের শঙ্কা। নিচের মানুষদের তাই দাবিয়ে রাখা হয়, ভয় দেখানো হয় যত প্রকারে পারা যায়।
যে কোনো অভ্যুত্থানেরই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য– মানুষের ভয় ভেঙে যাওয়া। এবারও সেটা ঘটেছে। ভয় ভেঙেছে একত্র হতে পারার কারণে। ভয় ভেঙেছে তারুণ্যের দরুন। তারুণ্যের অবিস্মরণীয় প্রতীক, আবারও স্মরণ করতে হয়, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের দুই হাত ছড়িয়ে বুক উঁচিয়ে পুলিশের উদ্যত অস্ত্রের সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়ানো। ওই ভাস্কর্য কেউ কখনও ভাঙতে পারবে না, কারণ ওটি তৈরি হয়েছে অভঙ্গুর উপাদানে এবং স্থান করে নিয়েছে আমাদের সমষ্টিগত ইতিহাসের পাতায়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্রঃsamakal.com