ফাহমিদা নবী। নব্বইয়ের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী। ক্ল্যাসিক, আধুনিক, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীতসহ সংগীতের অনেক শাখাতেই তার বিচরণ। সিনেমায় কাজ করে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সম্প্রতি কাজ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে ‘বিনোদন প্রতিদিন’-এর সাথে কথা বলেছেন তিনি।ন
বিরতির পর নতুনভাবে কাজ করতে কেমন লাগছে?
একটা সময় যখন আমি থেমে গিয়ে ফিরে আসলাম, তখন আর পেছনের দিকে ফিরতে হয়নি। সামনের দিকে এগিয়ে চলার একটি সুন্দর জায়গা পেয়েছি। সেই জায়গাটি কখনো ভাঙ্গছি, কখনো গড়ছি। সংগীত তো আসলে তাই, কখনো নিজেকে ভাঙা আবার গড়া। যেমন, গানের ভেতরে রোমান্স, আঘাত, ও ভালোবাসার ক্ষয় থাকে। সবকিছু মিলিয়ে একটা ওঠানামা আছে। আমার কাছে মিউজিকের পথচলাটা সে রকমই।
নিজেকে শিল্পী দাবি করলে কী শিল্পী হওয়া যায়?
শিল্পী হওয়ার প্রথম কাজ হচ্ছে চর্চায় থাকা। যতদিন বেঁচে থাকবে শিল্প হওয়ার জন্য ছুটতে হবে। তারকা হওয়া সহজ, কিন্তু শিল্পী হয়ে ওঠা অনেক সাধনার বিষয়। ধারা বদলালে কিন্তু হবে না। আমাকে একভাবে দর্শক-শ্রোতা নিয়েছে। সেই ধারাটায় যদি আমি না থাকি, একটা ব্যাঘাত হবে। এই ব্যাঘাত আবার অনেক দর্শক-শ্রোতা নিতে পারে না। তখন শিল্পী হয়ে ওঠার গতি থমকে যেতে পারে। সুতরাং শিল্পী হওয়া কঠিন, তারকা হওয়া সহজ।
শিল্পী হওয়ার জন্য কী কী পথ অবলম্বন করতে হবে?
একটা বটগাছে কেন পাখি থেকে শুরু করে মানুষরাও ছায়া খোঁজে, কারণ তার কাজটাই হচ্ছে ছায়া দেওয়া। বটগাছ হতে গেলে তো সাধনা করতেই হবে। তাহলে মেধার বিকাশ হবে। আমি যদি মনে করি, মানুষ আমাকে দেখুক, আমাকে খুঁজুক তাহলে হবে না। মেধা ও গুণকে প্রস্ফুটিত করতে হলে চর্চা করে যেতে হবে।
গানের ক্ষেত্রে এই প্রজন্মের তরুণরা কতটা সম্ভাবনাময়?
২০০৫ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ক্লোজআপ ওয়ানের সঙ্গে বিচারকের আসনে ছিলাম। যাদেরকে নিয়ে এসেছি, চেষ্টা করেছি তারা যেন এ প্ল্যাটফর্ম থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। তাদের জন্য ওই সময়ের শৈল্পিক যাত্রা খুব কঠিন ছিল কিন্তু যখন প্ল্যাটফর্ম হলো। তখন সহজ হয়ে গেল। প্ল্যাটফর্ম এখন প্রচুর আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে আশা করি। যত এই ধরনের কার্যক্রম থকবে, মেধার বিকাশ তত হবে। আমি তরুণদের নিয়ে আশাবাদী।
শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে সিনিয়ির হিসেবে কোনো দায়বদ্ধতা আছে?
প্ল্যাটফর্ম আমরা কিন্তু পাইনি। আমি তো অনেক বড় শিল্পীর কন্যা। আমার দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। আমাদের কিন্তু কেউ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেয়নি। আমরা নিজেরাই এগিয়েছি। আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি কিন্তু স্বপ্নের পথে নিজেকেই হাঁটতে হয়। পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি আমাদের সময় ছিল, এখন অতটা নেই। এইটার অভাবে কিন্তু অনেক মেধা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। আমরা যতটুকু পারি তরুণদের পাশে দাঁড়াচ্ছি। তবে বৃহত্তরভাবে কাজ করতে হলে সকলকে একটি জায়গায় আসতে হবে।
আপনার নতুন করে ফেরা সম্পর্কে জানতে চাই।
‘দুপুরের একলা পাখি’ এ্যালবামের মাধ্যমে ২০০৫ সালে বিরতি থেকে মাত্র গানে ফিরেছি। প্রায় ১২ বছর পর। তখন এই এ্যালবামের গানগুলি অন্য ভাবে করে দর্শকদের সামনে আসলাম। কারণ, আমার বোন সামিনা একরকম ভাবে গাইছে, ভিন্নজন ভিন্ন ভাবে গাচ্ছে অন্যদিকে আমার এতগুলো বছরের একটা গ্যাপ। সবকিছুর পর্যবেক্ষণ করে একটা ভালো কিছু করারা চেষ্টা করেছি। এই সময় একটি উপলব্ধির কথা বলি, যার যখন যেটা ভালো লাগে তার তখন সেটা করা উচিৎ। আমার দর্শক শ্রোতা কি চায়, আমি সেটা দেখবো না। আমি কি চাই এবং আমি দর্শকদের কি দিতে চাই সেটা দেখব।
ভিন্ন ধারা চর্চায় নিজেকে নিয়ে যে ভাঙা-গড়ায় মেতেছেন সেই সম্পর্কে বলুন।
সংগীত মনের কথা বলে, দুঃখ-সুখের কথা বলে। প্রেম-ভালোবাসা, স্বপ্ন-সাহস-উদ্দীপনার কথা বলে। সংগীত খুব কঠিন একটা সত্য এবং শিক্ষা। আমি নজরুলের গান অনেক পরে করি। আমাদের সময়ে ছোটবেলায় সকলে নজরুলের গানই করেছে। রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা দিয়ে আমাদের স্কুল জীবনের শুরু। এইগুলো তো আমাদের করতে হয়েছে। কিন্তু আমি আমার বাবাকে দেখেছি আধুনিক গান করতে। আমার গজল ভালো লাগে। আমি অনেক প্রকার গান শুনি। আমি গল্প বলতে ভালোবাসি।
অনেকদিন গান করার পরে আমার মনে হলো রবীন্দ্রনাথের গানগুলো আমি করব। তিনি কী বলতে চান, কোন মুহূর্তের কথা বলতে চান-আমি সেই মুহূর্তকে প্রকাশ করতে চাই। রবীন্দ্রনাথের গান করলাম গিটারে, বৃষ্টির শব্দে। দারুণ সাড়া পেলাম। তারপর আমি নজরুলের গান করার জন্য তিনটা মাস নজরুলকে পড়লাম। পড়াশোনা করার পর আমার মনে হলো আমি নজরুলের গান এবার করতে পারব। তারপর নতুন প্রজন্মের জন্য নজরুলের গান তবলায়, গিটারে, খালি গলায় করেছি। এরপর আমি সেলিম আল দীনের গান করেছি। এইটা এক ভিন্নমাত্রা যাকে বলে নাটকের গান।
গানের ভিউ বাণিজ্যের এই সময়ে শ্রোতা ও দর্শক নিয়ে কী বলবেন?
একটি ভালো গানের কথনো দর্শক হয় না। শ্রোতা হয়, তারা গান শোনে। আমাদের যত বিখ্যাত, প্রখ্যাত, কিংবদন্তি শিল্পী আছেন তাদের গানের এত ভিউ হয় না। তবুও তাদের গান মানুষের মুখে মুখে। তার কারণ কী? ভিউ দিয়ে কখনো একটি গানকে বিচার করা যায় না। কখনোই না।
সিনেমায় আবার কাজ করার ইচ্ছা আছে?
হ্যাঁ আছে। সিনেমার গান করতে আমার খুব ভালো লাগে। সামনে একটি নতুন প্রজন্মের পরিচালকের সিনেমায় গান করব। তারা যখন আমার কাছে প্রথমে আসে আমি জিজ্ঞাস করলাম, আমাকে কেন এই কর্পোরেট সময়ে চাচ্ছ-তখন তারা আমাকে বলল আমরা আপনাকে ভেবেই গানটি লিখেছি।