বদিউল আলম মজুমদার একজন অর্থনীতিবিদ, রাজনীতি বিশ্লেষক ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ। তিনি ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ও গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া তিনি নাগরিক সংগঠন ‘সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। সম্প্রতি তিনি নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার এবং অন্যান্য বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
আপনাকে অভিনন্দন নির্বাচন কমিশন সংস্কারের দায়িত্ব পাওয়ার জন্য। দায়িত্ব পাওয়ার পর কী কী সংস্কারের কথা ভাবছেন?
প্রথমত, আমাকে যে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হলো সে জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। একই সঙ্গে এ দায়িত্ব পেয়ে আমি সম্মানিত বোধ করছি। এ দায়িত্ব দেওয়ার মাধ্যমে আমার কাজের প্রতি আস্থা প্রকাশ করা হয়েছে। এত দিন ধরে আমি যে কাজটি করেছি, সেটা অনেক ব্যক্তির অবদানের ফসল।
নির্বাচনীব্যবস্থার সংস্কারের জন্য অনেক বিষয় জড়িত। প্রথম কাজ হলো, নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। সেটার জন্য ২০২২ সালে প্রধান নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য কমিশন নিয়োগের একটা আইন করা হয়েছিল। কিন্তু এটা সন্তোষজনক আইন নয় এবং এটা ভয়ানকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। এ আইনের মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তিকেই নিয়োগ দেওয়া যাবে। যেটা অতীতে করা হয়েছে। আর এ আইনটা একটা পাতানো নির্বাচন কমিশন গঠনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ জন্য এই নিয়োগ আইনটা আগে সংস্কার বা পরিবর্তন করতে হবে, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, প্রচলিত যে হলফনামা আছে সেটাকে যুগোপযোগী করতে হবে। এখন যেটা আছে, সেটা মান্ধাতার আমলের। প্রথমে যেটা করা হয়েছিল সেটা পরিবর্তন করা হয়নি। তাই হলফনামার পরিবর্তন ও পরিমার্জন দরকার।
তৃতীয় হলো, আরপিও বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশেরও কিছু পরিবর্তন করা দরকার। এ আইনটা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলা যেতে পারে। যেমন এ বিধানে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন সম্পর্কে বিধান আছে, কিন্তু লেজুড়বৃত্তি সংগঠনের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। আরপিও আইন অনুযায়ী, কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন থাকতে পারবে না। এসব কিন্তু এখনো সক্রিয়। আক্ষরিক অর্থে আইন মানা হলেও এর উদ্দেশ্যকে মানা হচ্ছে না।
এর বাইরে আরও কিছু বিষয় আছে। যেমন মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে ২০০৭ সালে যে আইন করা হয়েছিল, সেখানে বলা হয়েছিল স্থানীয় নেতা-কর্মীরা একটা প্যানেল তৈরি করে প্রার্থী মনোনয়ন দেবেন। কিন্তু আইন পরিবর্তন করে করা হয়েছে, প্যানেল বিবেচনা করে মনোনয়ন দেবে। এতে করে ইচ্ছেমতো মনোনয়ন দেওয়া শুরু হলো। এ জন্য নির্বাচনে ব্যবসায়ীরা আসতে পেরেছেন এবং টাকার খেলা শুরু হয়েছে। এটা হলো আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এ আইন পরিবর্তন করে নিশ্চিত করা দরকার যে প্যানেলের মাধ্যমে প্রার্থী মনোনীত করতে হবে।
আবার সংরক্ষিত নারী প্রার্থীদের ক্ষেত্রে হলফনামা নেই। সেটাও বাধ্যতামূলক করতে হবে। একই সঙ্গে বিরুদ্ধ হলফনামাও থাকতে হবে। কোনো প্রার্থী যে হলফনামা দেবেন, তিনি যদি ভুল তথ্য দেন, সেটা যেন কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারে। আর হলফনামার যাচাই-বাছাই বাধ্যতামূলক করা দরকার।
শুধু নির্বাচন কমিশন আইন সংস্কার করলেই কি ভালো নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে?
সম্ভব না। নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ভালো নির্বাচন করা তার অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু নির্বাচন কমিশন এককভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারবে না। কারণ নির্বাচনে অনেক অংশীজন থাকে। যেমন রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন, গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে একটা ভালো নির্বাচন হয়। কিন্তু তারা যদি তাদের দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে সম্ভব না। রাজনৈতিক দলগুলো যদি তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন না করে, তাহলে শুধু নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব না।
নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারলেও খারাপ নির্বাচন বন্ধ করতে পারে। যে নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে পারে না, সেটা করলে সংবিধানকে লঙ্ঘন করা হবে। কারণ মৌলিক কাঠামোর মধ্যে একটা হলো গণতন্ত্র। সেটা হয় সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে। যে নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট প্রতিফলিত হবে না, সেটা তারা বন্ধ করতে পারে। কিন্তু সদ্যবিদায়ী এবং আগের নির্বাচন কমিশন সেটা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তারা স্পষ্টতই সংবিধান লঙ্ঘন করেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। দলীয় লেজুড়ের ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু তারা স্বাধীনভাবে কীভাবে কাজ করতে পারে?
প্রথমত, সঠিক ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে। এবং সঠিক ব্যক্তিদের সৎ ও মেরুদণ্ডসম্পন্ন হতে হবে। তাঁরা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে না পারেন, তাহলে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে—এ রকম মেরুদণ্ডসম্পন্ন ব্যক্তি হতে হবে। কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবে না। সে রকম নির্লোভ ব্যক্তি না হয়ে যদি দলবাজ ও মেরুদণ্ডহীন হয়, তাহলে আগের পরিস্থিতিই বিরাজমান থাকবে। এ জন্য আইনি কাঠামো ঠিক করে সঠিক ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে। পাশাপাশি নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত অংশীজনদেরও সঠিক ভূমিকা পালন করতে হবে। তারা যেন কোনোভাবেই দলীয় পক্ষপাতিত্বের আচরণ করতে না পারে।
দেশে ক্রমাগত মব জাস্টিস বাড়ছে। এটা বন্ধ করতে করণীয় কী?
এটা বন্ধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমনভাবে দলীয় হয়ে গিয়েছিল যে তারা আর রাষ্ট্রীয় বাহিনী ছিল না। গত সরকারের পতনের পর পুরো সিস্টেমটাই ভেঙে পড়েছে। সে কারণে তারা এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। একই সঙ্গে নাগরিকদেরও এসব জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যেমন আমরা বলতে পারি গত ৫ আগস্টের পর দেশে কোনো ধরনের পুলিশিব্যবস্থা সক্রিয় ছিল না। কিন্তু সাধারণ জনগণ এলাকায় দলবদ্ধ হয়ে পাহারা দিয়ে চুরি-ডাকাতি সামাল দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই ট্রাফিক সিস্টেম নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব পালন করেছে।
মাজারে হামলা এবং সংখ্যালঘুদের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে হামলা অব্যাহত থাকলে নতুন বাংলাদেশ গড়া কীভাবে সম্ভব?
এসব অব্যাহত থাকলে আমরা কিছুই করতে পারব না। নিঃসন্দেহে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় কিছু বাড়াবাড়ি ছিল। যেটা আমাদের কাছে কাম্য নয়। আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলে কয়েক লাখ লোক মারা যাবে। আওয়ামী লীগের পতন তো বিএনপির কারণে হয়নি এবং তারা ক্ষমতায়ও যেতে পারেনি। এ ঘটনাটা সারা দেশের বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার
কারণে সম্ভবপর হয়েছে।
এখন কথা হলো, ক্ষমতা পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের নেতাদের আশঙ্কা তো ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সেভাবে কিন্তু ক্ষতি হয়নি। কিন্তু আমার কথা হলো, যতটুকু আঘাত হয়েছে সংখ্যালঘুদের ওপর, সেটারও আমি নিন্দা জানাই। এ রকম ঘটনা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপর থাকতে হবে। যেকোনোভাবেই হোক আইনশৃঙ্খলাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
দখলদারি, চাঁদাবাজি এখনো অব্যাহত আছে। এসব বন্ধে অন্তর্বর্তী সরকার তো কিছু করছে না।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা যদি রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন না করতে পারি, তাহলে দখলদারি, চাঁদাবাজি বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এসব বন্ধে অর্ন্তবর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্রিয় করার চেষ্টা করছে। শোনা যাচ্ছে, যেসব পুলিশ বাহিনীর সদস্য প্রথমে পালিয়ে গিয়ে পরে কাজে যুক্ত হয়েছেন, তাঁদের একটা অংশ এ সরকারের সফলতা চায় না। কারণ তাঁরা এখনো চরমভাবে দলীয়। এ কারণে পুলিশ বাহিনীতে এখনো স্বাভাবিকতা ফেরেনি। এ ঘটনাগুলো বিরাট চ্যালেঞ্জ।
আমাদের একটা কথা স্মরণে রাখতে হবে যে এ সরকার কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো না। তাদের কাজ রুটিন মাফিক না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো নীতিনির্ধারণী কাজ করতে পারত না। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারকে নীতিনির্ধারণী ভূমিকাও পালন করতে হচ্ছে। যেখানে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে, সবকিছু জোড়া লাগিয়ে সংস্কার করতে হবে। সবকিছুকে নতুন করে বিন্যস্ত করা চারটিখানি কাজ নয়।
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, এটা কতটা সাংবিধানিক আর কতটা না?
এটা কোনো সমস্যা না। তাঁরা সংবিধান মেনেই শপথ গ্রহণ করেছেন। যেহেতু আমাদের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, তিনি দেশ ত্যাগ করেছিলেন। তাই তাঁদের এভাবে শপথ নিতে হয়েছে। যেভাবে ক্ষমতার রদবদল হওয়ার কথা, সেটা সেভাবে হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের একটা নির্দেশনা নিয়ে তাঁরা সরকার গঠন করেছেন। এটা সাংবিধানিকভাবে অসাংবিধানিক নয়।
একটা প্রশ্ন হলো, আমাদের ভবিষ্যতের জন্য সংবিধান নতুনভাবে লেখা বা পুনর্লিখন করা দরকার কি না, সেটা জাতি হিসেবে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনাকেও ধন্যবাদ।
সূত্র :ajkerpatrika.com