শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে রয়েছে অনন্য এক সম্পর্ক। যে বন্ধনে রয়েছে শাসন, স্নেহ আর ভালোবাসা। অন্যায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারেন সৎ এবং সাহসী একজন শিক্ষক। আর সারাজীবনে তার এই ত্যাগ ও সংগ্রামে শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি হয়ে উঠেন শিক্ষার্থীবান্ধব একজন শিক্ষক। একজন নিঃস্বার্থ শিক্ষকই জাতির ক্রান্তিলগ্নে অসামান্য অবদান রেখে থাকেন। তেমন একজন অনুপ্রেরণাকারী, আলোর দিশারি মানুষ হলেন প্রফেসর ফারুখে আযম মুঃ আব্দুস ছালাম। যিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে বর্তমানে খুলনার সরকারি হাজী মুহাম্মদ মুহসিন কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন৷
সময়ের সাহসী এই শিক্ষক চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। পুরো দেশে যখন সরকার বনাম ছাত্র-জনতার মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করেছে তখনও তিনি প্রহরী হয়ে রক্ষা করেছেন নিজের চলমান এবং প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের। গণ-অভ্যুত্থানের সময় প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
সময়টা সেদিন আগষ্টের ৩ তারিখ। এক দফা থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে গিয়ে আহত অবস্থায় পুলিশের হাতে আটক হন হাজী মুহাম্মদ মুহসিন কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী নাফিজ মাহমুদ। যে খবর পাওয়া মুহুর্তেই ছুটে চলে যান তার কলেজের অধ্যক্ষ ফারুখে আযম মুঃ আব্দুস ছালাম। খুলনার সোনাডাঙা মডেল থানা থেকে রাজনৈতিক সব সমস্যা উপেক্ষা করে দায়ভার কাঁধে নিয়ে তাকে ছাড়িয়েও নিয়ে আসেন।
২৪ জুলাই ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন চলাকালে কলেজের পার্শ্ববর্তী ছাত্রাবাসে শিক্ষার্থীদের গ্রেফতারের সময় তিনি পুলিশকে বাধা দেন। কিন্তু তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সরাসরি নির্দেশে পুলিশ তাঁর শিক্ষার্থীদের গ্লেফতার করে।
সারা বাংলাদেশে যখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় আন্দোলন সংগ্রাম করে আহত হয়েছে কিংবা পুলিশ হেফাজতে আটক হয়েছেন তখন উল্লেখযোগ্য এমন কোন সরকারি কলেজের শিক্ষক অজানা কারণে প্রত্যক্ষভাবে
শিক্ষার্থীদের পাশে এসে দাঁড়ান নি। কিন্তু প্রফেসর ফারুখে আযম মুঃ আব্দুস ছালামের
এসব দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নায্য অধিকারের দাবিতে থাকা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মনোবল আরও চাঙ্গা করে। এছাড়া কলেজের এইচ.এস.সি ২০২৩ এর শিক্ষার্থী নাঈম হাওলাদার ও এম.বি.এ ২০১৯-২০ এর শিক্ষার্থী আমানউল্লাহ ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে গুলিতে মারাত্মক আহত হলে তাদের পাশে থেকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন তিনি।
অধ্যক্ষ হওয়ার আগে তিনি সরকারি ব্রজলাল কলেজের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ, বাগেরহাট সরকারি প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজসহ বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন এবং এসব কলেজের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট নানা ক্ষেত্রে উন্নয়নের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
২০২৪ সালের ৭ মার্চ মুহসিন কলেজে যোগদানের পর থেকে কলেজের শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফল, ওয়েবসাইট সংস্কার, রোভার স্কাউট চালু, কলেজের অবৈধ দখলকৃত সম্পত্তি উদ্ধার, দুর্নীতিমুক্ত কলেজ নিশ্চিতকরণ, পুরো কলেজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, কলেজ মসজিদ সংস্কার, কলেজের যাবতীয় ফি অনলাইনে জমা দেওয়ার পদ্ধতি চালু, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাস হাজিরা নিশ্চিতসহ নানা অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। সবশেষ ১০ কোটি টাকার ৬ তলা বিশিষ্ট একটি ভবন নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে তিনি গত ১৮ আগস্ট কলেজ ক্যম্পাসে বিজয় স্তম্ভ ‘স্বাধীনতা’ উদ্বোধন করেন।
মুহসিন কলেজের শিক্ষার্থী মুহতারম বলেন, ফারুক স্যার পুরো আন্দোলনজুড়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষে ছিলেন। আগষ্টের প্রথম দিকে নতুন পাওয়া চব্বিশের এই স্বাধীনতা অনিশ্চিত জেনেও তিনি সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। এমনকি কারা কারা আন্দোলনে যায় প্রশাসন থেকে তার কাছে জোর দিয়ে নামের তালিকা চাইলেও তিনি তা দেন নি। যা আমাদের আন্দোলনকে গতিশীল করেছিলো।
তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আলী হাসান বলেন, অধ্যক্ষ মহোদয় কলেজে যোগদানের পর থেকে সবকিছু ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন ঘটছে। প্রথমে আমাদের কিছুটা অবহেলিত মনে হলেও, আমরা নতুন করে সবকিছু ভাবতে শিখছি।
এ বিষয়ে ফারুখে আযম মুঃ আব্দুস ছালাম বলেন, সরকারি হাজী মুহাম্মদ মুহসিন কলেজে যোগদানের পর থেকে আমি চেষ্টা করছি কলেজটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত, পুরো ক্যাম্পাস সিসি টিভি ক্যামেরায় অন্তর্ভুক্ত, কলেজের অবৈধ দখলকৃত দোকানঘর উদ্ধার, শিক্ষক পরিষদ নির্বাচন করাসহ নানাভাবে চেষ্টা করছি কলেজটির সুনাম ফিরিয়ে আনতে। সবশেষ স্বাধীনতা স্তম্ভ উদ্বোধন এবং ৬ তলা একাডেমিক ভবনের কাজ শুরু করেছি। আশা রাখছি, যতদিন এ কলেজে থাকতে পারবো ততদিনে কলেজটি গুছিয়ে নিয়ে খুলনায় সেরাদের কাতারে নিতে পারবো।
উল্লেখ্য, আন্দোলন চলাকালীন ২৫ জুলাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও থ্রেডস এ তিনি একটি পোস্ট করেন। যেখানে তিনি লেখেন,
‘সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের সকল প্রিয় শিক্ষার্থীসহ সারাদেশের সন্তানদের মাঝেই বেঁচে থাকতে চাই।’ তার এ ধরনের কিছু পোষ্টে আন্দোলন বেগবান হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে উদ্ভুদ্ধ হচ্ছে এমন অভিযোগ তুলে কলেজের প্রশাসনিক ভবন ঘেরাওসহ তাকে হেনস্তা করার চেষ্টা করেন স্থানীয় আ. লীগের নেতাকর্মীরা। একপর্যায়ে তাকে ফেসবুক থেকে উল্লেখিত পোস্টটিসহ এমন আরো কিছু পোস্ট ডিলেট করতে বাধ্য করা হলেও থ্রেডস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনও সেগুলো রয়েছে।