অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ চিন্তায় অনড় থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘যে যত পরামর্শ দেয় এটা থেকে বেরিয়ে আসার, সে পরামর্শ তোমরা গ্রহণ কোরো না। তোমাদের চিন্তায় স্বচ্ছ, সঠিক—এটা মুঠো থেকে ছাড়বে না। যদি আমরা এ স্বপ্ন থেকে দূরে সরার কোনো কাজ করি, স্মরণ করিয়ে দেবে। আমাদের কারও কোনো ইচ্ছা নেই এ স্বপ্ন থেকে বাইরে যাওয়ার, এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা আমাদের সার্বক্ষণিক কাজ।’
রোববার বেলা ১১টা থেকে তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি কার্যালয়ের শাপলা হলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়, যা চলে বেলা দেড়টা পর্যন্ত। মতবিনিময় সভায় প্রধান উপদেষ্টা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল; বন, পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান; মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার; তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। সভায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে কথা বলতে এবং খোঁজখবর নিতে দেখা যায়।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ভুলক্রমে আমরা যদি সীমা অতিক্রম করি, তাহলে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে জানাবে। এ শপথ নিয়ে আমরা সবাই একত্র হলাম। যারা আজকে উপস্থিত হতে পারে নাই, তাদের জানিয়ে দিও আমরা একযোগে, একসঙ্গে এ কাজে নামলাম। এটাকে সফল করব।’
তিনি বলেন, ‘দুনিয়ার মানুষ এসে তোমাদের কাছে শিখতে আসবে, তোমাদের নিয়ে যাবে, বলবে কী মন্ত্র দিয়ে এটা করেছ? এ মন্ত্রটা তারা শিখতে আসবে। সে মন্ত্রটা তোমরাও টের পাচ্ছ না, এটা কীভাবে আসল? কিন্তু একটা বিরাট মন্ত্র তোমরা আবিষ্কার করেছ। সেটাকে ধরে রাখবে। এ মন্ত্র যদি শিথিল হয়ে যায়, তাহলে আমাদের কপালে অশেষ দুঃখ আছে। সেই দুঃখ যেন আমাদের দেখতে না হয়।’
শিক্ষার্থীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এত দিন চুপচাপ শুয়ে শুয়ে এরা (আওয়ামী লীগ) স্বপ্নের মধ্যে ছিল। স্বপ্ন দেখছিল, আনন্দ সহকারে লুটপাট করে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে তাদের ঘুম ভাঙে। তারা কি চুপচাপ বসে থাকবে? খুব চেষ্টা করবে তোমাদের আবার দুঃস্বপ্নে ফিরিয়ে নিতে। শান্তিতে তাদের আবার রাজত্ব চালাতে। তাদের চেষ্টার ত্রুটি করবে না। কাজেই যে কাজ শুরু করেছ, তা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এর থেকে বেরিয়ে যেয়ো না।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্ম থেকে ৫৩ বছরে এ সুযোগ আর আসে নাই। যে সুযোগ তোমরা আমাদের দিয়েছ। এ সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়। এ সুযোগ হাতছাড়া হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ থাকবে না। এটা কোনো রাষ্ট্র আর থাকবে না। এটা যেন শুধু রাষ্ট্র নয়, পৃথিবীর সম্মানিত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। যেহেতু তরুণেরা এটার হাল ধরেছে। এ কারণে এটা ইউনিক, অন্যান্য দেশ আমরা তৈরি করতে চায়।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূস শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘দেখছি আর ভাবছি—কী একটা স্বপ্ন আমাদের সবার সামনে, তোমাদের সামনে, জাতির সামনে তোমরা নিয়ে এসেছ। প্রথমেই যারা শহীদ হয়েছে, তাদের স্মরণ করি। যারা শহীদ হয়েছে, তারা চলে গেছে। তোমাদের দিকে তাকাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম—তোমরাও শহীদ হয়ে যেতে পারতে। আজকে যারা আমাদের সঙ্গে বসতে পারত, সেই সুযোগ তাদের দেওয়া হয়নি। আমরা এ পাড়ের আর ও পাড়ের মানুষ হয়ে গেছি। দুর্ঘটনাচক্রে, নিশ্চিতভাবে বলার উপায় ছিল না—তুমি এখানে থাকবে, তুমি ওখানে থাকবে। কেউ হয়তো এক ঘণ্টা আগে রওনা হয়েছে, কেউ হয়তো এক ঘণ্টা পরে রওনা হওয়ায়…।’
আহতদের দেখতে হাসপাতালে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘যখন হাসপাতালে তাদের দেখার জন্য যাই, তাকাতে কষ্ট হয়। একটা ছেলে, একটা মেয়ে এইরকমভাবে কীভাবে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই দিকে পা চলে গেছে, ওই দিকে…’ এ কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন ড. ইউনূস।
আপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘একজন তাজা তরুণ রংপুরে আমাকে বললে, ফুটফুটে একটা ছেলে, স্যার আমি সারা জীবন ক্রিকেট খেলতে চেয়েছিলাম। ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলাম। এখন দেখেন আমার পা কেটে ফেলেছে…। সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে স্যার ক্রিকেট খেলব কী করে? ক্রিকেট তার মাথা থেকে যাচ্ছে না, পা নাই যতবার দেখি ততবার মনের সঙ্গে প্রশ্ন জাগে, এটিই আমরা বাংলাদেশ বানিয়েছি, যে এতগুলো তাজা প্রাণ, তাদের ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। আমরা যারা আজকে এখানে বসে কথা বলছি, তাদের একমাত্র দায়িত্ব তাদের এই ত্যাগ, এই জীবনের বিনিময়ে তারা আমাদের এখানে বসার সুযোগ দিয়েছে, তারা না গেলে আমরা আজকে এখানে বসতে পারতাম না সবাই, আমরা সরকারের মধ্যে বসেছি…কেউই একই ভূমিকায় আসতে পারেতাম না।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘কালকে একটা হাসপাতালে গেলাম। আবার সেই দৃশ্য কচি কচি প্রাণ, মাথার খুলি উড়ে গেছে। মাথার অর্ধেক নাই, গুলি মাথার ভেতর রয়ে গেছে। রংপুরের হাসপাতালের দৃশ্য, এক্স-রে দেখাচ্ছে, ওখানে দাগ ছোট ছোট ফুটো করা, আমি বুঝতে পারলাম না আমাকে কী দেখাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কী, এতগুলো গুলি তার শরীরে রয়ে গেছে, সে বেঁচে আছে রাবার বুলেট…যতবার দেখি যতবার শুনি আবার নতুন করে প্রতিজ্ঞা করতে হয় যে স্বপ্নের জন্য তারা প্রাণ দিয়েছে, সেই স্বপ্নকে আমরা বাস্তবায়ন করব। এটার থেকে আমাদের বেরিয়ে যাবার উপায় নাই। আমাদের যোগ্যতা না থাকতে পারে, ক্ষমতা না থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের প্রতিজ্ঞা রইল, আমরা এটা করব। আমি খালি দেখি, এই যে দৃশ্য দেখলাম, এটা তো সবাই দেখছে না, যারা হাসপাতালে আসছে তারা দেখছে, প্রতিদিনের ঘটনা, মানুষকে জানাতে হবে বোঝাতে হবে এর পেছনে কী ছিল মানুষ এমনিতেই তোমাদের পেছনে…।’
তথ্য : আজকের পত্রিকা