তিন মাস নিষেধাজ্ঞা থাকার পর বনজীবী ও পর্যটকদের জন্য খুলছে সুন্দরবনের দুয়ার। তাই শুরু হয়েছে নৌকা ও জাল মেরামতের তোড়জোড়। সবকিছু ঠিক থাকলে মাছ ও কাঁকড়া ধরার জন্য আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে সুন্দরবনে যেতে পারবেন বনজীবীরা। একই সঙ্গে সুন্দরবনের গহীনে ভ্রমণ করতে পারবেন পর্যটকরাও।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জ, কৈখালী ও রমজাননগর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চুনা, চুনকুড়ি, মালঞ্চ ও খোলপেটুয়া নদীর পাড়ে সবাই পুরোনো নৌকা, ছেঁড়া জাল মেরামত ও রঙ করার কাজে ব্যস্ত। তাদের মুখে হাসির ঝিলিক। মাছ ও কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষগুলোর দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হতে চলায় চারদিকে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ।
শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী এলাকার ষাটোর্ধ্ব হানিফ গাজী ছোটবেলা থেকেই মাছ ধরার পেশায় জড়িত। সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ-কাঁকড়া ধরা নিয়ে তার রয়েছে নানান অভিজ্ঞতা। বৃহস্পতিবার সকালে কথা হয় নীলডুমুর এলাকায় নদীর পাড়ে নৌকা মেরামতে ব্যস্ত ওয়াহেদ গাজীর (৬০) সঙ্গে। তিনি বলেন, যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই বাদায় (সুন্দরবনে) মাছ-কাঁকড়া ধরার কাজে জড়িত। এখন পর্যন্ত এ পেশায় আছি। বছরের দুটি সময় মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। তখন আমাদের অন্য কাজ করে সংসার চালাতে হয়। মাছ ধরা শুরুর আগে ঋণ করে নৌকা মেরামত ও জাল কিনে নদীতে নামি। তবে মাছ পাওয়ার বিষয়টি ভাগ্যের ওপর। নদীতে নামলে অনেক সময় মাছ পাওয়া যায়, আবার অনেক সময় খালি হাতে ফিরতে হয়।
তিনি আরও বলেন, নিষেধাজ্ঞা দিলে মাছ ধরা থেকে বিরত থাকি। তবে সরকার থেকে যে সহায়তা দেওয়া হয় সেটি দিয়ে সংসার চলে না। এ কারণে অন্য কাজ করে উপার্জন করি। সরকার সুন্দরবন ও মাছ-কাঁকড়া রক্ষায় যে অভিযান চালায় সেটি আরও কঠোর এবং নেট জাল ও কারেন্ট জালের ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধসহ অবৈধভাবে সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের প্রবেশ বন্ধ করা দরকার। তাহলে সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ-কাঁকড়া পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
একই ইউনিয়নের জেলে আবু হাসান সরদার (৪৫), জামাল হোসেন (৩৫), রফিকুল সরদার (৪০)। তারা নদীতে নামার জন্য জাল ও নৌকা মেরামতের কাজ করছেন।
তারা জানান, তিন মাস সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়া আহরণ থেকে বিরত থাকায় সংসার অনেক কষ্টে চলেছে। কারণ মাছ-কাঁকড়া ধরা ছাড়া তারা অন্য কোনো কাজ করতে পারেন না।
তারা আরও বলেন, প্রতিটি নৌকায় ২-৫ জন জেলে থাকে। পাঁচজনের পাঁচটি পরিবার। আমাদের মাছ পাওয়ার ওপর নির্ভর করে সংসার। মাছ পাওয়া গেলে সংসার ভালো চলে। না পাওয়া গেলে কষ্ট করেই চলতে হয়। অনেকে সন্তানদের নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করেন।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা, জীবজন্তু ও মাছের প্রজনন বাড়ানোর জন্য ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৯২ দিনের জন্য সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ, কাঁকড়া ধরা ও পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এর আগে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে প্রজনন মৌসুম হিসেবে বন্ধ রাখা হয়েছিল কাঁকড়া ধরা। ফলে সুন্দরবনের মাছ ও কাঁকড়া ধরার ওপর নির্ভরশীল মানুষ চরম কষ্টে ছিল। আগামী ১ সেপ্টেম্বর সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে।
সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ অফিস সূত্রে জানা যায়, ১ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত সাতক্ষীরা রেঞ্জের চারটি স্টেশন থেকে বিএলসি (বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট) হয়েছে ২ হাজার ৯০০টি।
বুড়িগোয়ালিনী স্টেশন কর্মকর্তা এ.বি.এম হাবিবুর রহমান জানান, সাধারণত একটি নৌকায় ২-৬ জন করে মাছ কিংবা কাঁকড়া ধরতে সুন্দরবনে ঢুকে থাকেন। ১ সেপ্টেম্বর থেকে আবার মাছ ও কাঁকড়া ধরার অনুমতি দেওয়া হবে। এতে করে আবার কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসবে। জেলেদের সমস্যা দূর হবে।
সুন্দরবন ট্রলার মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি আনিছুর রহমান জানান, পর্যটকের ওপর নির্ভর করে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায় পাঁচশতাধিক ট্রলার চলে। সুন্দরবনে জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত মাছ ও কাঁকড়া ধরা বন্ধ রাখার পাশাপাশি পর্যটক ঢোকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় তাদের প্রায় এক হাজার ট্রলারচালক ও শ্রমিক বেকার জীবনযাপন করেন। তাদের সংসার চলে খুব কষ্টে ধার দেনা করে।
তিনি বলেন, পরিস্থিতি ভালো হলে এবার এই রেঞ্জে আসা পর্যটকদের জন্য আধুনিক লঞ্চ সার্ভিস চালু হবে।
সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা সংগঠন সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটি সাতক্ষীরার আহ্বায়ক সালাউদ্দিন বাপ্পি বলেন, বছরের প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস সুন্দরবনে মাছ ও কাঁকড়া ধরা বন্ধ থাকে। মৎস্য বিভাগ প্রতিবছর মাছের প্রজনন মৌসুমে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরা বন্ধ রাখে। এই অবসরকালে সাগরে মাছ ধরা জেলেদের মাথাপিছু ৮৬ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। অথচ সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের জন্য কোনো সুবিধা কিংবা বরাদ্দ নেই। তিনি এ সময় বেকার হয়ে পড়া জেলে ও বাওয়ালীদের জন্য বরাদ্দের দাবি জানান।
সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এম কে এম ইকবাল হোছাইন চৌধুরী বলেন, তিন মাস পর ১ সেপ্টেম্বর থেকে জেলে ও বাওয়ালীদের সুন্দরবনে ঢোকার পাস (অনুমতি) দেওয়া হবে। এ জন্য আগে থেকে জেলে বাওয়ালীর পাশাপাশি পর্যটক পরিবহনকারী ট্রলার মালিকেরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।